বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ, স্ত্রীর স্বীকৃতি না দিয়ে নবজাতককে বিক্রি
আগস্ট ৯, ২০২৩
হাসপাতালে খালেদা জিয়া
আগস্ট ৯, ২০২৩

শিক্ষকের প্ররোচনায় ঘর ছাড়া আবু বক্কর, ভুল বুঝে ফিরলো স্বাভাবিক জীবনে

নিজস্ব প্রতিবেদক,ঢাকা

নারায়ণগঞ্জের বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে আবু বক্কর ওরফে রিয়াসাদ রাইয়ান। স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালেই ২০২১ সালে শিক্ষক আল আমিনের মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হয়।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তরুন ১২ জনের দলের সঙ্গে তথাকথিত হিজরত করে পাহাড়ে যায়। সেখানে যাবার পর নিজের ভুল বুঝতে পারে। ফেরার চেষ্টা ও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করতে দেয়া হয়নি তাদের।

পালাতে গিয়ে দু’বার ধরা পড়ে চরম নির্যাতনের শিকার হয় আবু বক্কর। সর্বশেষ গত মার্চ মাসের প্রথম দিকে আবু বক্করসহ বেশ ক’জন পালাতে সক্ষম হয়।

গতকাল মঙ্গলবার(৮ আগস্ট) রাতে তারা র‌্যাব-১১ ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে রাইয়ানসহ চার তরুন আত্মসমর্পণ করেন ও নিজেদের পরিচয় ও কথিত হিজরতের পর নিজেদের ভুল বোঝার তথ্য দিলে র‌্যাব তাদের আটক করে।

তারা হলেন, নারায়ণগঞ্জ বন্দরের আবু বক্কর ওরফে রিয়াসাদ রাইয়ান (১৬), সিলেট ওসমানী নগরের মো. হাসান সাইদ (২৬) ও শেখ আহমেদ মামুন (২৩), এবং মাদারীপুরের মো. ইয়াছিন (২১)।

নারায়ণগঞ্জ র‌্যাব-১১ ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ে স্বেচ্ছায় হাজির হওয়া নতুন জঙ্গি সংগঠন “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া” সদস্য রাইয়ানসহ তরুনকে আটকের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব।

বুধবার(৯ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত বছরের ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে ৮ জন তরুণ নিখোঁজ হয়। নিখোঁজ তরুণদের পরিবার কুমিল্লার কোতয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। র‌্যাব নিখোঁজ তরুনদের উদ্ধারে গোয়েন্দা নজরদারি কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া” নামক একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের তথ্য পায়।

র‌্যাব জানতে পারে, এই সংগঠনের সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কেএনএফ’ এর সহায়তায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।

পরবর্তীতে ২০২২ সালের অক্টোবর দেশের বিভিন্ন স্থানে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ইতোমধ্যে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাসহ সর্বমোট ৭৮ জন এবং পাহাড়ে অবস্থান, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কার্যক্রমে জঙ্গিদের সহায়তার জন্য পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কেএনএফ’ এর ১৭ জন নেতা ও সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।
র‌্যাব ইতোমধ্যে সংগঠনটির আমীর আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, সংগঠনের দাওয়াতি শাখার প্রধান আব্দুল্লাহ মায়মুন, সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও উপ প্রধান মানিক, অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান রাকিবসহ অন্যান্যদেরকে গ্রেফতার কএরছে।
কমান্ডার মঈন বলেন, ২০২১ সালে ভুল একটা পথকে সঠিক মনে করে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন কেবিন ক্রু মা আম্বিয়া সুলতানা ওরফে এমিলি। তিনি নিজেই তার একমাত্র ছেলেকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে প্রশিক্ষণের জন্য পাহাড়ে পাঠিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি র‌্যাবের ডি-র‌্যাডিকালাইজেশন এর মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে অনুতপ্ত হয়ে ছেলেকে ফিরে পেতে গত ৯ নভেম্বর র‌্যাবের সহায়তা কামনাসহ গণমাধ্যমের সামনে হাজির হয়ে তার সন্তান রাইয়ানসহ অন্যান্য তরুণদেরকে ফিরে আসার আকুতি জানান।

গতকাল র‌্যাব-১১ কার্যালয়ে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করা চার তরুন সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, র‌্যাব-১১ তাদের পরিচয় নিশ্চিতে ইতোপূর্বে র‌্যাবের কর্তৃক প্রকাশিত নিখোঁজ ৫৫ জন তরুণের তালিকায় তাদের নাম দেখতে পেয়ে তাদেরকে আটক করে।

ভুল ব্যাখ্যা-চাকরির প্রলোভনে কথিত হিজতর চার তরুনের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া ও তাদের ফিরে আসা সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, তারা বিভিন্ন সময়ে তাদের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিত জনের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়’তে যোগদান করে। পরবর্তীতে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা তাদেরকে ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে তথাকথিত হিজরতের কথা বলে বা চাকুরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পাহাড়ে গমনে আগ্রহী করে।

পাহাড়ে যাবার পর ভুল ভাঙ্গে তাদের
পার্বত্য অঞ্চলে গমনের পর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কেএনএফ’ এর সহযোগিতায় সংগঠনটির সশস্ত্র প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য কার্যক্রম ও চিন্তাভাবনা দেখে তাদের ভুল ভাঙ্গে। আরো বেশ কিছু সদস্যসহ এই চার তরুন ফিরতে চাইলেও ফিরতে দেয়নি জামায়াতুল আনসারের সদস্যরা। বরং তাদেরকে বন্দি রেখে নির্মম নির্যাতন করা হয়।

পালাতে গিয়ে দুবার ধরা পড়ে নির্যাতনের শিকার হয় চার তরুন পাহাড়ে নিয়েই তাদের জোরপূর্বক রশদ পরিবহন, রান্নাবান্না, প্রশিক্ষণের গর্ত করা, ঘর বানানোসহ বিভিন্ন ধরণের কাজে বাধ্য করা হয়। ২০২২ সালের জুন মাসে সিপ্পি পাহাড় থেকে পালিয়ে রনি পাড়া এসে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে যাওয়ার রাস্তা খোঁজার সময় কেএনএফ সদস্যদের নিকট ধরা পড়ে চার তরুন। জঙ্গি ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে তাদের বন্দি রেখে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। তারা আবারও পালানোর চেষ্টা করলে তাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়।

পাহাড়ে র‌্যাবের অভিযানের মধ্যে পালানোর সুযোগ মেলে র‌্যাবের অভিযান শুরু হলে তারা পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। সুযোগ বুঝে তারা অন্য সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গত মার্চে পলায়ন করে তারা সমতলে চলে আসে। তারা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে।

এ সময় তারা র‌্যাবের নিকট জঙ্গিদের আত্মসমর্পন ও ভুল বুঝতে পারা জঙ্গিদের আইনগত সহযোগিতা প্রদানের বিষয়টি তারা জানতে পরিবারে যোগাযোগ করে। পরিবারের উৎসাহে ও আইনগত সহযোগিতা পাবার আশায় তারা র‌্যাব-১১ কার্যালয়ে আত্মসমর্পণ করে।

হাসান সাঈদ সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, সিলেট ওসমানী নগরের স্থানীয় মাদ্রাসা হতে দাওরা হাদিস সম্পন্ন করা হাসান সাঈদ ২০২১ সালে শুরা সদস্য মায়মুনের মাধ্যমে উগ্রবাদে জড়ায়। ২০২১ সালের নভেম্বরে শুরা সদস্য রাকিবের মাধ্যমে পাহাড়ে যায়। পাহাড়ে যাওয়ার পর সাঈদেরও অন্য তরুনদের মতো ভুল ভাঙ্গে। দুই বার পালাতে গিয়েও ধরা পড়ে নির্যাতনের স্বীকার হয়।

শেখ আহমেদ মামুন’কে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সে সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রকৌশল বিষয়ে অধ্যয়নরত ছিল। ২০২১ সালে সাঈদের মাধ্যমে জামায়াতুল আনসারে যোগ দেয়। ২০২১ সালের নভেম্বরে সাঈদ ও আরো বেশ করয়েকজন তরুনের সঙ্গে পাহাড়ে যায়।
ইয়াসিন ছিল মাদারীপুরের একটি দোকানের ঘড়ি মেকানিক। সিরাজের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে ২০২১ সালের নভেম্বরে পাহাড়ে যায়। পার্বত্য অঞ্চলে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম দেখে সে ভুল বুঝতে পারে এবং সমতলে ফিরে আসে।

কুকি-চিন ও নতুন জঙ্গি সংগঠনের পরিত্যক্ত একটি ক্যাম্প থেকে দুই জঙ্গি সদস্যের লাশ উদ্ধার সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)’র পাহাড়ে তিনটি ট্রেনিং সেন্টার ছিলো। এই তিনটি ক্যাম্পের একটি থেকে হোমিও চিকিৎসক ডাক্তার আহমেদ ও রাইয়ানের গৃহশিক্ষক আল আমিনের লাশ উদ্ধার করা হয়। আজ আত্মসমর্পণ করা এই চার জন আলাদা ক্যাম্পে থাকায় সরাসরি হত্যার ঘটনা দেখেনি। তবে তারা অন্য সদস্যদের মাধ্যমে জেনেছেন, বিভিন্ন সময়ে কেএনএফ এর সঙ্গে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হতো। আবার নিজেরাও জড়িয়ে যেতেন। এই সকল সংঘর্ষের সময়ে প্রশিক্ষণরত জঙ্গি সদস্যদের সামনে রেখে সংঘর্ষ কতো। এমনই এক সংঘর্ষে ডাক্তার আহমেদ মারা যান। আর আল আমিনের মৃত্যুর বিষয়টি সম্পর্কে তারা জেনেছেন, প্রশিক্ষণের সময়ে বিভিন্ন নির্যাতন, না খাইয়ে রাখা, তাদের দিয়ে অমানবিক কাজ করানো হত। যেমন প্রশিক্ষণের জন্য তৈরি করা গর্ত, খাল তাদের দিয়ে কাটানো হতো। আল আমিন প্রশিক্ষণ অবস্থায় মারা যেতে পারে।

স্বেচ্ছায় হাজির হওয়া ৪ তরুনকে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে কমান্ডার মঈন বলেন, তারা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করলেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। তাদের ফিরে আসার বিষয়টি আদালত নিশ্চয় সুবিচার করবে। এক্ষেত্রে র‌্যাবের পক্ষ থেকে আইনী সহায়তা দেয়া হবে।
এখনো নিখোঁজ সাত তরুনকে খুঁজছে র‌্যাব নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসারে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘর ছাড়া ৫৫ তরুনের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। এরমধ্যে ৪৮জন আত্মসমর্পনসহ আটক হয়েছে। তবে এখনো নিখোঁজ সাত তরুন। তাদের আইনের আওতায় আনার তৎপরতা চলমান বলে জানান কমান্ডার মঈন।

//এস//

rr
rr

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *