জাকির হোসেন:
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব ইউক্রেনের রুশ-সমর্থিত দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী এলাকা, দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। জবাবে রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে বলে জানান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। এরপর ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন ঘোষণা করেন তিনি ইউক্রেনে একটি ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করবেন। ঘোষণার কয়েক মিনিট পর কিয়েভে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এরপর যা ঘটে তা ছিল ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন এবং হাজার হাজার রাশিয়ান সৈন্যের ইউক্রেনের সীমানা অতিক্রম। চলে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ। ইউক্রেনে এখনও আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। ইউক্রেনও বসে নেই। তারাও পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ। ইসরায়েল রীতিমতো ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। প্রায় আট দশক ধরে সংঘাত চলছে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে। এই সংঘাত-সহিংসতা ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে। শুধু ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ না থেকে এই ইস্যু নিয়ে বিরোধের হাওয়া ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে ফিলিস্তিনের। তাই হঠাৎ করেই হামাস ইসরায়েলের ওপর গত ৭ অক্টোবর শনিবার থেকে আক্রমণ শুরু করার পরে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে ইসরায়েল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচন করতে যার ঘুম হারাম হয়ে গেছে, তাদের প্ররোচনায় লাশের শহর গাজা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেনের মতো এখানেও অস্ত্র বিক্রির বাজার করে ফেলবে। এদের প্ররোচনায় ফিলিস্তিনের বাতাসে বারুদের গন্ধ। মাইলকে মাইল বাড়ির পর বাড়ি ধসে যাচ্ছে ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলি এবং গোলাবারুদের হামলায়। অবুঝ শিশু আলো-বাতাসের পার্থক্য বোঝার আগেই বিদায় নিচ্ছে পৃথিবী থেকে। তারা বুঝতে শেখেনি তাদের কী অপরাধ। তাদের কোথায় কবর দেওয়া হবে, তা-ও জানে না তার বাবা-মা। কারণ, সব জায়গায় ইসরায়েলি হিংসার ক্ষত। একটা কবর খোঁড়ার জায়গা পর্যন্ত অক্ষত নেই। কোথাও কবর দিলেও সেই কবরও কি অক্ষত থাকবে? হতভাগা বাবা-মা কি দেখতে পারবে সন্তানের কবর? সব জায়গা হিংসার গুলিতে ঝাঁঝরা, বোমায় ছিন্নভিন্ন, আগুনে দগ্ধ, কংক্রিটের ধ্বংসস্তূপের চাপায় পিষে-থেঁতলে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের লাশের মিছিল। বধ্যভূমি, মৃত্যুপুরী, জল্লাদের মঞ্চ— কোনো বিশেষণেই ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান গণহত্যা, নৃশংসতা-নিপীড়ন স্পষ্ট হয় না; কিছুতেই পাওয়া যায় না তাদের দুঃখ-দরিয়ার কিনারা! ইসরায়েলও বারবার বিমান হামলার মাধ্যমে আক্রমণ করছে। ২০০৭ সাল থেকে গাজা উপত্যকাকে অবরোধ করে রেখেছে। ইসরায়েল বলছে তারা দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই এই অবরোধ দিয়ে রেখেছে।
৫০ বছর আগে, ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর মধ্যপ্রাচ্যের আরব, মিসর ও সিরিয়া যৌথভাবে ইসরায়েলকে আক্রমণ করে। সেবারও এই হামলার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না ইসরায়েলিরা। যুদ্ধের পর গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে তদন্তও করেছিল তেল আবিব। এ যুদ্ধের পরিণতি, কেবল ওই অঞ্চলেই নয়, বরং পুরো বিশ্বেই পরিবর্তনের সূচনা করেছিল।
ফিলিস্তিনিদের আবাসস্থল পশ্চিম তীরও ইসরায়েলি খুনে বাহিনীর ‘মহড়াক্ষেত্র’। ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকটের মধ্যস্থতা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ মধ্যস্থতাকারী ইসরায়েলের সহায়তায় এখন অস্ত্র-গোলাবারুদসহ বিমানবাহী নৌবহর পাঠাচ্ছে। কী অভিনব মধ্যস্থতাকারী! ইউক্রেনে তারা অস্ত্র বিক্রি করে যুদ্ধ টিকিয়ে রাখছে বছর বছর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধের প্রভাবে বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে একটি প্রজš§ গড়ে উঠবে আমিষের ঘাটতি নিয়ে। এ সংকট নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই! কেউ বলছে না, পৃথিবী আর যুদ্ধ দেখতে চায় না, এ যুদ্ধ বন্ধ করো। এত শিশুর কান্নার রোল পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছে। চোখ বুজলে দেখতে পাওয়া যায় হিংসার গোলার আঘাতে শিশুর শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে হাত-পা। লাশ হয়ে পড়ে আছে মানুষ-শিশু। সেখানে কামানের গোলার শব্দে পাখির ডাক শোনা যায় না।
মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারের একচিলতে জায়গায় গুলি-গোলা-ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফাঁক গলে কোনোমতে টিকে থাকা লাখ পনেরো গাজাবাসীর ওপর পর্বতসম চেপে আছে ইসরায়েলের সর্বাত্মক অবরোধ। তাদের লাগাতার হামলায় গাজার ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ আজ বাস্তুচ্যুত। কংক্রিটের দানবাকৃতি দেওয়াল দিয়ে ঘেরা গাজার চতুর্দিকেই হাজারও ইহুদি সেনার চৌপ্রহর সশস্ত্র প্রহরা। এর আসমানটি খোলা বটে, তবে সেখানে চন্দ্র-সূর্য-তারার চেয়ে ইসরায়েলের জঙ্গিবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, বোমার ঝাঁকের দেখাই বেশি পাওয়া যায়। অবরুদ্ধ জনপদটির বাতাসও ভরে গেছে রাসায়নিক হামলার মারণ-বিষে। সেই বিষ দেহে ধারণ করে জন্মাচ্ছে বিকলাঙ্গ-পঙ্গু শিশু। ‘ফিলিস্তিনি’ শুধু এ পরিচয়ের জন্য আর দশজনের মতো সেই শিশুদেরও স্বাভাবিক মৃত্যুর ভাগ্য নেই! এ মৃত্যু যখন-তখন; দিন-রাতের ভেদ তো নেই-ই, ধর্মীয় উৎসবের দিন, এমনকি প্রার্থনার সময়ও ট্রিগার টিপতে এতটুকু হাত কাঁপে না ইসরায়েলি যুদ্ধবাজ সেনাদের। তাই পবিত্র ঈদের দিনেও প্রাণ হারান নিরীহ ফিলিস্তিনি।
১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ সাল নাগাদ তিন বছরে আরবদের সঙ্গে ইহুদি সশস্ত্র যোদ্ধাদের লড়াইয়ে অন্তত পাঁচ হাজার ফিলিস্তিনি মারা যায়। ১৫ থেকে ২০ হাজার ফিলিস্তিনি আহত ও সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ বন্দি হয়। ১৯৪৭ সাল নাগাদ ইহুদিরা ফিলিস্তিনের ছয় শতাংশ দখল করে নেয়।
এই সংঘাতের একদিকে রয়েছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, আরেক দিকে রয়েছে ইসরায়েলের নিরাপত্তার দাবি। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড বেন গুরিয়ন ইহুদিদের জন্য এই অঞ্চলে একটি ‘নিরাপদ আবাসভূমি’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নের মুখে পালিয়ে বেড়াতে থাকা ইহুদিরা নিরাপত্তা পাওয়ার আশায়ই ইসরায়েলে এসে আশ্রয় নেন।
ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা আসার পর দিন থেকে ব্রিটিশ শাসনাধীন ফিলিস্তিনে যে যুদ্ধ শুরু হয়, তাতে সাড়ে সাত লাখের মতো আরব মানুষ নিজেদের আবাস ছেড়ে পার্শ্ববর্তী জর্ডান, লেবানন, সিরিয়ায় আশ্রয় নেন। অনেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে বসবাস শুরু করেন। নিহত হয় অন্তত ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি। ইহুদিরা দেশটির ৭৮ শতাংশ দখল করে নেয়। বাকি ২২ শতাংশ ছিল এর ভেতরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন এলাকা।
জাকির হোসেন, সম্পাদক, সিটিনিউজ সেভেন ডটকম