বিয়ে করছেন মেহজাবীন, পাত্র যিনি
ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৫
‘নতুন রাজনৈতিক দলে যোগদানের বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত নয়’
ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৫

গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

জাকির হোসেন:

গণতন্ত্রের সঙ্গে বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। গণতন্ত্রে বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত হওয়ায় তথ্য বা ইনফরমেশন থাকে সূর্যালোকের মতো স্পষ্ট ও প্রকাশ্য। তথ্য যখন বন্দি কিংবা অবরুদ্ধ হয়ে আঁধারে তলিয়ে যায়, তখন গণতন্ত্র জীবন্ত থাকে না। গণতন্ত্রে তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকতেই হবে। পক্ষান্তরে, স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদে তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব থাকে না। স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদ বিশ্বাস করে, মানুষের হাতে তথ্য থাকলে শাসকের নিরবচ্ছিন্ন আধিপত্য ও ধাপ্পাবাজির ক্ষেত্রে উচিত সমালোচনা করা সম্ভব হবে। শাসকের কাজ-কারবার নিয়ে যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপিত হবে। স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদের গৃহীত জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিবাদ সঞ্চারিত হবে। অতএব, স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদে তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভয়ের বিষয় এবং পরিত্যাজ্য।

অথচ গণতান্ত্রিক পরিসরে তথ্যের অধিকারকে অন্যতম যুগান্তকারী আইন বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে তথ্যের অধিকারের মূল উদ্দেশ্য হলো, প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বাড়ানো এবং কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতার আওতা বৃদ্ধি করা। গণতান্ত্রিক সমাজের নাগরিকদের মধ্যে তথ্যের অধিকারের বিস্তৃতি তাদেরকে সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে যায় এবং জনঅধিকারের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে। একইসঙ্গে তথ্যের অধিকারের চর্চার মাধ্যমে অব্যবস্থা, অনিয়ম ও দুর্নীতির অচলায়তনে আঘাত করা সম্ভব হয়। এতে সাধারণ নাগরিকরাও প্রশাসনের খুঁটিনাটি ব্যাপারে তথ্য জানতে পারেন এবং প্রয়োজনে প্রশ্ন করতে তৎপর হন। রাষ্ট্র ও সরকারের একচ্ছত্র ও অপরিসীম ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষ কিছুটা হলেও আওয়াজ তুলতে সক্ষম হয় তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে। তবে এমন অধিকার একমাত্র গণতন্ত্রে সম্ভব হলেও স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদের অধীনে মোটেও সম্ভব নয়।

স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদের তথ্য হলো একতরফা বয়ান। বহুমতের চিহ্নও সেখানে রাখা হয় না। সরকার যা বলবে, সেটা মানা ও বিশ্বাস করতে বাধ্য হওয়াই স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদে শাসনতান্ত্রিক সংস্কৃতি। স্তাবক ও বশংবদরা যে মিথ্যা কিংবা আরোপিত তথ্য প্রচার করবে তোতা পাখির মতো, সেগুলো উচ্চারণ করা স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদের অধীনস্থ জনতার একমাত্র কাজ। ফলে কোনো প্রশ্ন, বিতর্ক বা সমালোচনা ছাড়াই স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদে নানা রকমের ন্যারেটিভস তৈরি হয়। কে জঙ্গি, কে দেশপ্রেমিক, সে লেবেল দেওয়া হয় উদ্দেশ্যমূলকভাবে। এসব লেবেল পরীক্ষা করে দেখার বিন্দুমাত্র সুযোগও রাখা হয় না স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদের কাঠামোর মধ্যে।

স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদের পতনের পর পরিস্থিতি বদলায়। তখন জাতিসংঘ বা বিচার বিভাগীয় তদন্তে বের হয় আসল তথ্য। উন্মোচিত হয় সত্য। যেমনটি হয়েছে জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে। খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর চালানো দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় আমরা খুব খুশি। গুম, খুন, টর্চার সেল এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কীভাবে ছাত্রদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে-তার সবকিছু ডকুমেন্ট আকারে প্রতিবেদনে এসেছে। এর মাধ্যমে বিশ্ববাসী আবারও জানতে পারল তারা কী ধরনের নির্মমতা চালিয়েছিল।’

স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদের কারণে আরেকটি বড় বিপদ হয়েছিল শাসন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে। অনেক কিছুই ভেঙে গিয়েছিল ব্যক্তি ও দলের দাপটের কারণে। ফলে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দাঁড় করানোর দরকার হয়। এসব কারণে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়ে ১৫টি কমিশন গঠন করে। এখন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের আলোকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে এবং কোন কোন প্রস্তাব গ্রহণে ঐকমত্যে পৌঁছান যায়, সেগুলো নির্ধারিত হবে। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ এগিয়ে নেওয়ার জন্য একটি ‘ঐকমত্য কমিশন’ও গঠন করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক বাংলাদেশে চলমান যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যক্রমের নেপথ্যে মূল প্রেরণা হলো গণতান্ত্রিক উত্তরণ এবং স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের চির অবসান। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তরে পর আবার নিজেদের কাজে ফিরে যাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের ঘোষিত অভিপ্রায় হলো, ‘পুরোনো বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, তাই আমরা নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ করতে চাই। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সব পর্যায় থেকে আমরা অনেক বড় সহায়তা পাচ্ছি।’ এ কাজে সফল হলে অন্তর্বর্তী সরকার ইতিহাস সৃষ্টি করবে এবং নিজেরাও ইতিহাসের সম্মানজনক স্থানে অধিষ্ঠিত হবে।

এ কথা সত্য যে, অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পূর্ণ মূল্য দিচ্ছে। অতীতের যা কিছু স্বৈরতন্ত্রের ত্রাসে চাপা পড়েছিল এবং ফ্যাসিবাদের তাণ্ডবে রক্তাক্ত হয়েছিল, সেসব তথ্য ও সত্য ক্রমেই উন্মোচিত হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে প্রশ্ন উচ্চারিত হচ্ছে, ‘জুলাই বিপ্লবের খুনিরা কোথায়?’ এমন প্রশ্ন সদ্য বিগত বাংলাদেশে অকল্পনীয় ছিল। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তরা প্রতিকার চাইছেন। মামলা করছেন। বিচার প্রক্রিয়া স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলেছে। গণতন্ত্রের আরেক গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত ন্যায়বিচার বা আইনের শাসনের আবহ আবার ফিরে আসছে, যা অতীতে দল, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর করায়ত্ত ছিল।

তবে জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী পরিস্থিতি মোটেও শান্ত নয়, বহুলাংশেই সংকুল। মতলববাজরা ন্যায়বিচার বা আইনের শাসনকে বিকৃত করছে। অর্থের লোভে বা প্রতিহিংসার কারণে শুরু হয়েছে মামলা বাণিজ্য। অতীতের মতোই বর্তমানেও এসব মামলা বাণিজ্যে সরকারি কর্মকর্তা ও অসাধু পুলিশ অফিসারদের যোগসাজশ রয়েছে। প্রবাসী বা নিরীহ মানুষকে মামলার আসামি করে হয়রানি করা হচ্ছে। হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা। এতে প্রকৃত অপরাধীদের বদলে সাধারণ মানুষ নাজেহাল হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিহিংসা চরিতার্থ হচ্ছে। বহুজনকে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে অত্যাচার করার বিষয়টি গণতান্ত্রিক সমাজের ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি।

জাকির হোসেন, সম্পাদক, সিটিনিউজ সেভেন ডটকম

rr
rr

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *