ভারতে মুসলিম বিদ্বেষ যন্ত্রণা দেয়: পদ্মলক্ষ্মী
এপ্রিল ২৯, ২০২২
পরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া না নেয়ার আহ্বান কাদেরের
এপ্রিল ২৯, ২০২২

ঈদে মানুষের বাড়ি ফেরা

মোঃ জাকির হোসেন:

শরণার্থী শিবিরের পথে আমরা হেঁটেছি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের আগের বছর ভারত উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় ভেসে গেছে ইতিহাস। আমরা শরণার্থী দেখেছি, আমরা শরণার্থী হয়েছি। ১৯৭১ সালে আমরা শরণার্থী ছিলাম। শরণ খুঁজছে যারা, তারাই শরণার্থী। শরণ মানে আশ্রয়।

এখন যেমন, ইউক্রেনের মানুষ শরণার্থী হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে, আফগানিরা শরণার্থী হয়ে আছে অনেক দেশেই। এখন বাংলাদেশেও আছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। শরণার্থীরা যখন রাস্তা, টার্মিনাল, স্টেশন বা নদীঘাটের দিকে ছুটে যেতে থাকে, সেই দৃশ্য আলোকচিত্রে উঠে আসে। সংবাদ হয়ে আসে। প্রামাণ্যচিত্রে ধরা থাকে। পরে সেই আলোকচিত্র বা প্রামাণ্যচিত্রের শিল্পমান বিচার করার সুযোগ আসে আমাদের। ঈদের সময় ঢাকা থেকে মানুষ নিজের বাড়িতে ফেরে, হুড়মুড় করে তারা ফিরতে চায় নিজের দেশের বাড়িতে। এই ফেরা তো শরণার্থী হয়ে ফেরা নয়, একে অনেকেই বলে, নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা। তাহলে জীবনবাজি রেখে এভাবে বাড়ি ফেরার মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা কী অথবা কী কী?

গত দু’বছরের করোনার কঠিন সময়েও মানুষ ঈদের সময় একপ্রকার যুদ্ধ করেই বাড়ি ফিরেছে, আমরা দেখেছি। মানুষের ভিড়ে ফেরি ডুবে গেছে, লঞ্চ ডুবি হয়েছে। বাসের টিকিট নেই, রাস্তায় তখন বাস চলাচলই বন্ধ, তবু মানুষ পায়ে হেঁটে বা ঝুঁকিপূর্ণ কষ্টকর পথেই বাড়ি ফিরেছে। এই ফিরতে গিয়ে অনেকেই শরণার্থী শিবিরের পথে যেমন হয়, পথেই কেউ কেউ মরে গেছে। সভ্যতা থমকে গেছে। হাহাকার তৈরি হয়েছে। শহরের অনেকেই, যাদের বাড়ি আছে শহরে, তারা বা তাদের শ্রেণির অনেকেই মন্তব্য করেছেন, ‘এভাবে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফেরার দরকারটা কী?’

গ্যালারিতে বসে গ্ল্যাডিয়েটরের জীবন-মৃত্যু খেলা দেখার আনন্দ পেয়েছি আমরা! হতাশ মানুষের মুখ দেখার মজা পেয়েছি আমরা! কেননা, আমরা ভালোই জানি যে, ঈদের সময় নগরের ষাট- সত্তর ভাগ মানুষ তাদের গ্রামের বাড়ি ফিরবে। যত কষ্টই হোক, তারা ফিরবে। সেই মানুষেরা জানে, তাদের জীবন যৌবন ঢেলে পেশাগত বাস্তবতায় শহরকে তারা গড়ে তুলছে বটে, কিন্তু এ শহর তাদের নয়। এ শহর মনে হয় দূর কোনও অন্য দেশের কর্মভূমি! কর্মক্ষেত্রের বাইরে তাদের সেই কয়েক ফুট ঘরের ভাড়াটিয়া জীবন। বাথরুমে শাওয়ার নষ্ট তাই বালতির মগ ঢেলে নিত্য গোসল। সারাবছর বন্দিজীবনের মতো তাদের ছোটছোট চাকরি বা এটা-ওটা টুকটাক কিছু একটা করে খাওয়ার জীবনজীবিকা। এরকম মানুষই বেশি, এই দেশে। দেশের প্রায় সত্তর ভাগ মানুষের সম্পদ ভোগ করে যাচ্ছে বাকি অংশ মানুষ। এটাই বাংলাদেশ। চিরবঞ্চনার এই দেশে তারা আদতে গ্রামীণ কৃষি সম্প্রদায়ের মানুষ।

কিন্তু বেঁচে থাকার তাগিদে তারা শহরবাসী। তাই তাদের ফিরতেই হয় গ্রামে, কারণ, তাদের পারিবারিক প্রিয়জনেরা প্রায় সব্বাই সেই গ্রামে বাস করে। হয়তোবা শহর তাদের জীবনে এক প্রিজন ভূমি, তাই তাদের ঈদের ছুটি মানেই কয়েক দিনের প্যারোলে মুক্তি! মুক্তির আনন্দে তাই হুড়মুড় করে বাড়ি ফেরার উন্মাদনা লেগে যায়। বাড়ি বলতে তো আর শুধু একটা চিনের চালের ঘর বা খড়ের ঘর ও মাঝখানে একটি উঠোন শুধু নয়, বাড়ি এক বিস্তৃত স্বাধীনতার নাম। বাড়ির পেছনে ঘন বাঁশবাগান, সন্ধের বাঁশবাগানে কী অর্ক্রেস্ট্রা, একবার উৎকর্ণ হয়ে ভাবো! বাড়ি বলতে বাগানে জোনাকির কথা একবার ভাবো। সন্ধ্যার চাঁদ তো পাগল, সেই পাগল চাঁদটার শ্রী দ্যাখো। বাঁশবাগানের পরেই তো নদী, বাড়ি বলতে সেই কৈশোরক নদী! নদীর কথাই উঠল যদি, নদীর নাম কি খঞ্জনা? নদীর নাম কি নবগঙ্গা, মধুমতী, নদীর নাম কি ঘুঙুর? নদীর ওপারে দুধস্বর, রতিডাঙ্গা, বসন্তপুর, দহকোলা, দেবতলা গ্রাম… কোন গ্রামে বসত করে সেদিনের সেই কিশোরী, ক্লাস নাইনে থাকতেই যার বিয়ে হয়ে যায়? বাড়িতে বলতে কি অবলুপ্ত মাধুরীর আঁচে সিক্ত সেই কিশোরীর মুখ? বাড়ি বলতে কি নয় গাড়াগঞ্জ বাজার, স্কুল মাঠ, পোস্টাপিসের বারান্দা?

সারাবছর কোম্পানির দাস হয়ে, পোশাক রফতানি কারখানার দর্জিদাসী হয়ে যে জীবন মানবসন্তানের, আমাদের, যে ঘিঞ্জি গলির কোণায় রাতে ঘুমোবার জীবন, সেই জীবন থেকে ঈদের ছুটি মানেই কয়েক দিনের মুক্তি। তাই বাড়ি বলতে দিগন্তের দিকে চলে যাওয়া আলপথের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যেখানে শৈশব ঘুমিয়ে আছে সেই ঘুম না ভাঙিয়ে চুপচাপ নিজেকে দেখা! বাড়ির ধারণা একরৈখিক নয়, তাদের, যারা প্রাণপাত করতে করতে শহর ছেড়ে অনেক কষ্ট মেনে নিয়েও বাড়িতে যায়। তাছাড়া, কে আছে এই শহরে তাদের, শুধু কিছু শোষক ছাড়া?

কবি বলেছেন, ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?’ যে জীবন অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন নয়, সে জীবন স্বাধীন কতটাই বা আর? বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে এবং এরই মধ্যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ অতিক্রান্তও হলো। তাহলে একটি দেশের রাজধানী থেকে মানুষের বাড়ি ফেরার চিত্র এরকম শরণার্থীদের মতো হবে কেন? আর দেশের কিছু মানুষের ভোগের জন্যে সব সম্পদ তাদের দখলে চলে যাবে আর অধিকাংশ মানুষ বঞ্চিত থাকবে, কেন? এই ‘কেন’র উত্তর দেবে কে? দেশের মূল উৎপাদক কৃষক শ্রেণিই হচ্ছে এদেশের প্রধান অবহেলিত সমাজ, আর তাদের ছেলে-মেয়েরাই শহরে চলে আসে রুটিরুজির জন্যে।

ঈদের সময় তারাই বাড়ি ফেরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ কি জানে না, ঈদে এই মানুষেরা বাড়ি ফিরবে? তাহলে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই কেন? মানুষ বাসে টিকিট পাবে না, একদিন দুইদিন দাঁড়িয়ে থাকবে টার্মিনালে, শুধু বাড়ি ফেরার একটি টিকিটের আশায়, কমলাপুর স্টেশনে নারকীয় ভিড়ে দাঁড়িয়েও মানুষ টিকিট পাবে না, অতিরিক্ত মানুষের চাপে লঞ্চ ডুবি হয়ে শতশত মানুষ মারা যাবে তাও আমরা জানি, তবু এর প্রাক-প্রতিকার ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। এ কী গ্যালারিতে বসে গ্ল্যাডিয়েটরের জীবন-মৃত্যু-খেলার দেখার সুপ্ত অভিপ্রায় নয়?

প্রতিটি মানুষের জীবনই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকের প্রিয়জনই প্রত্যেকের কাছে প্রিয়। সাংবিধানিকভাবেও সবার গুরুত্ব সমান নিশ্চিত করা হয়েছে। তাহলে ঈদের সময় কেন শরণার্থী হয়ে আমাদের চোখের সামনেই, যাত্রাপথে প্রত্যেক বছরেই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যায় শতশত মানুষ। ক্ষয়ক্ষতির পর অনেক বড় বড় কথাবার্তা হয়, গণমাধ্যম তার আইটেম পায়, কিন্তু যাদের জীবন এই ক্ষতির শিকার হয়, তারা আর কিছুই পায় না। এমন কি প্রিয়জনের লাশও পায় না। না, তারাও কিছু পায়। জীবনভর তারা বুকের মধ্যে কষ্ট পায়, হাহাকার পায়। আর্তনাদ ঘিরে থাকে তাদের বাড়ির উঠোন, মাটির বারান্দা। চাপাচাপা কান্না তাদের জন্যে বরাদ্দ আজীবন। তাহলে সাংবিধানিকতার অর্থ রইল কোথায়?

কথার পরে কথা হয়। কথা চলতেই থাকে। ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষের জীবন বাস্তবতা নিয়েও কথা চলতে থাকে। আমরা কথার ভেতর দিয়ে কোথাও পৌঁছতে চেয়েছি, পৌঁছতে চাই। চাই, সত্যিকারের কার্জকর ব্যবস্থা নিয়ে ঈদে ফেরা মানুষকে দুর্ঘটনার ক্রূরতা থেকে মুক্তি দেওয়া হোক। মানুষ আনন্দে, স্বস্তিতে বাড়ি ফিরুক। প্রিয়জনদের সঙ্গে একত্রে থাকার ঈদ উৎসবে মিলুক। সুখ আসুক ঘরে ঘরে। একটা মানবজীবনে আর কত যন্ত্রণা নেবে এদেশের সাধারণ মানুষ? লাখ লাখ প্রাণ দিয়ে স্বাধীন করে আনা গণযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশ, বাংলাদেশ। বৈষম্যই যদি আমাদের গন্তব্য না হয়, তাহলে এদেশ সবার হয়ে উঠুক। দুর্ঘটনায় মুহূর্তেই শত মানুষের মৃত্যুর দেশ থেকে বেরিয়ে আসুক বাংলাদেশ। সত্যি, যদি তাই হতো, খুব ভালো হতো, খুব ভালো হতো।

আশা, খুব ভালো হোক। যাদের দায়িত্ব, তারা তা করুক। করেই প্রমাণ করুক, তারাও মানুষ এবং সাধারণ মানুষের জন্যে তাদেরও সত্যি সত্যি ভালোবাসা আছে।

মোঃ জাকির হোসেন, সম্পাদক, সিটিনিউজ সেভেন ডটকম

 

rr
rr

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *