জাকির হোসেন:
বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নয়নশীল ও ঘণবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি দেশ। উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী কর্মসংস্থানের জন্য সবসময় শহরমুখী হচ্ছে। যার ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে নগরায়ন। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুয়ায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৩৯% লোক নগরে বসবাস করে। দ্রুত নগরায়ন ও নগরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে বাড়ছে নানা ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব। এর সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব। জলবায়ুর এই পরিবর্তনের ফলে নগর স্বাস্থ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে নানা রকম সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের প্রকোপ। যেমন— হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনির জটিলতা, হরমোনের জটিলতা, ফুসফুসের সমস্যা, ডায়রিয়া, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গুসহ নানা ধরনের রোগ। এর জন্য দায়ী করা হয় নগরের অপরিচ্ছন্নতা, দূষিত পরিবেশ, অপরিকল্পিত নগরায়ন, যত্রতত্র ময়লা আর্বজনা ফেলে রাখা ইত্যাদি কারণকে। বর্তমান সময়ে মানুষ যেসব রোগে বেশি সংক্রমিত হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডেঙ্গু।
ডেঙ্গু, দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ভেক্টর-বাহিত রোগগুলোর একটি। সাধারণত ডেঙ্গুর উৎপত্তি হয় জমে থাকা পানি থেকে। বাড়ির ছাদে কিংবা বারান্দার ফুলের টবে, নির্মাণাধীন ভবনের বিভিন্ন স্থানে, রাস্তার পাশে পড়ে থাকা টায়ার কিংবা অন্যান্য পাত্রে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে। এক্ষেত্রে নগরের আবাসনগুলোতে ডেঙ্গু অধিক হারে বিস্তার ঘটে।
বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ৫০-১০০ মিলিয়ন ডেঙ্গু ভাইরাসের (ডিএনভি) সংক্রমণ ঘটে। প্রাথমিকভাবে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয় (সিডিসি, ২০১৬)। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্তের মাত্রা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব ঘটে ১৯৬৪ সালে। এটিকে ঢাকা ফিভার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্তমানে ১২৮টি দেশে ডেঙ্গু ফিভারকে (ডিএফ) মশাবাহিত সর্বাধিক বিস্তৃত রোগ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে (র্ব্যাডি এট আল, ২০১২)। আর এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি পরিলক্ষিত হয় বিশ্বের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলগুলোতে।
সাধারণত বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে উচ্চ তাপমাত্রা এবং আপেক্ষিক আদ্রতা বিশেষ করে গ্রীষ্মের মাসগুলোতে এডিস এজিপ্টি এবং এডিস অ্যালবিপিক্সার মশার উৎপত্তির জন্য উত্তম সময়। এই সময়ে ডেঙ্গু রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। তবে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ২০২২ সালে ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব দেখা দেয় ডিসেম্বর-ফ্রেরুয়ারিতে। এই রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় ২০১৯ সালে। ওই বছরের সরকারি হিসাব মতে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। সেই সময়ে দেশের ৬৩টি জেলা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি রোগী ছিল শহর এলাকার। এর আগে ২০০০ সালেও ডেঙ্গু তার ভয়াল রূপ প্রদর্শন করে। ওই বছরের সরকারি হিসাব মতে পাঁচ হাজার ৫০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল নগরে যার হার ছিল ৬৪.৫%। বাংলাদেশে ২০০০ সালের পর থেকে ডেঙ্গু জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর এর প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। সর্বশেষ ২৮ জুলাই, ২০২৩ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যনুয়ায়ী বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪৪২০৫ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২৪৫ জন।
ডেঙ্গু ভাইরাস (ডিএনভি) এর চারটি সেরোটাইপ রয়েছে (ডিএনভি-১, ডিএনভি-২, ডিএনভি-৩, ডিএনভি-৪) এবং এদের প্রত্যেকটির দ্বারা সংক্রমিত হওয়া সম্ভাবনা রয়েছে। এই ভাইরাসগুলোর মধ্যে কোনো একটি দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর ১৮ মাসের মধ্যে যদি পুনরায় অন্য কোনো সেরোটাইাপে আক্রান্ত হয় তাহলে রোগীর মারাত্মক বা সিভিয়ার ডেঙ্গু হতে পারে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। পরবর্তীতে যা তীব্র ফ্লু জাতীয় অসুস্থতার কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে যে ধরনের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জ্বর হওয়া, অতিরিক্ত মাথা ব্যাথা, চোখের চারপাশে ব্যাথা, পেশিতে ও হাড়ের গিটে ব্যাথা, বমি বা বমি বমি ভাব, ত্বকে লাল ছোপ ছোপ দাগ, নাক থেকে রক্তপাত ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথম ১০ দিনের মধ্যে এই লক্ষণগুলি দেখা যায় এবং কিছু ক্ষেত্রে বেশি সময় লাগে যা শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে।
ডেঙ্গুর জন্য কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। সময়মত ডেঙ্গু সনাক্তকরণ, গুরুতর সংক্রমণের সতর্কতা লক্ষণ চিহ্নিত করা এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ রোগীর মৃত্যু রোধে মূল উপাদান হিসাবে কাজ করে। সরকারের কমিউনিক্যাবল ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) বিভাগের অন্যতম পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা মতে, বর্তমান সময়ে জ্বর হলে বিশ্রামে থাকতে হবে। অধিক পরিশ্রম করা যাবে না।
নগরে ডেঙ্গুর প্রভাব কমানোর জন্য স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের নগর শাখা-২ কর্তৃক ডেঙ্গু প্রতিরোধের নির্দেশনায় সকল নগর এলাকায় মশক নিধন কার্যক্রম গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। মানসম্মত কীটনাশক ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ডেঙ্গু রোগীর তথ্য প্রাপ্তির সাথে সাথে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এছাড়া নগরে বসবাসকারী নাগরিকদের আরও সচেতন করার জন্য উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ এর মতো ডেঙ্গু প্রতিরোধে টাস্কফোর্স গঠন করে তাদের নির্দেশনা অনুয়ায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে বিনামূল্যে ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করতে হবে বলেও তারা অভিমত প্রকাশ করেছেন।
জাকির হোসেন, সম্পাদক, সিটিনিউজ সেভেন ডটকম